ঢাকা,বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪

দশদিনে সারা দেশে ৩৩২ জন খুন, নিরাপত্তাহীন সাধারণ মানুষ

20160427121642_julhasনিউজ ডেস্ক:: 

গত দশদিনে সারা দেশে ৩৩২ জন খুন হয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থার তথ্য অনুযায়ী তিনমাসে দেশে অন্তত ১৫’শ মানুষ খুন হয়েছে। একটিরও সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি। পুলিশের তথ্যানুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চারমাসে দেশে খুন হয়েছে ১১৯২। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ২৬৭, ফেব্রুয়ারি ২৯১, মার্চে ৩০৭ ও এপ্রিলে ৩২৭ জন।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীতে নিজ বাসায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাবেক প্রটোকল কর্মকর্তা জুলহাস মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয়কে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় দায় স্বীকার করেছে আনসার আল ইসলাম নামে একটি জঙ্গি সংগঠন। এইদিন সকালে কাশিমপুর কারাগারের গেটের সামনে প্রধান কারারক্ষী সার্জেন্ট ইন্সট্রাক্টর রুস্তম আলীকে গুলী করে হত্যা করা হয়। এর একদিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রেজাউল করিমকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পর গতকাল মঙ্গলবার শেরেবাংলা নগরের রাজাবাজার এলাকা থেকে হুমাইরা জাহান সুখি নামে এক বিমান বালার লাশ উদ্ধার করা হয়।

এসব ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, দেশকে অস্থিতিশীল করতেই এসব টার্গেট কিলিং হচ্ছে। ২০ দলীয় জোটের নির্দেশে এসব হচ্ছে। অন্যদিকে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক বলেছেন-পুলিশ ঘরে ঘরে পাহারা দিতে পারবে না। জঙ্গিদের টার্গেট সম্পর্কে জানার মেকানিজম পুলিশের কাছে নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কাউকে নিরাপত্তা দিতে পারছে না। হত্যাকাণ্ডের পর খুনিদের গ্রেফতার করতে পারছে না আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। দেশে বিরোধী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকলেও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের নিয়ে বেশি সময় ব্যস্ত থাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ফলে অপরাধী গ্রেফতারের চেয়ে রাজনৈতিক মামলার আসামীদের গ্রেফতারে ব্যস্ত থাকছে বেশি। রাজনৈতিক কর্মসূচি না থাকলেও পুলিশকে তার পাহারায় থাকতে হচ্ছে। এসব কারণে হত্যাকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে। অধিকাংশ ঘটনারই সুরাহা করতে পারছে না তারা।

গত ২৪ এপ্রিল রাজধানীর ভাটারা থানাধীন বসুন্ধরায় বালুর মাঠের পাশ থেকে এক অজ্ঞাত তরুণীর গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। বস্তাবন্দী অবস্থায় তার লাশ পাওয়া যায়। পুলিশের ধারণা, তাকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে। গত রোববার ভোরে সাভারের আশুলিয়ায় সীমা (২২) নামের এক পোশাক শ্রমিককে গলাকেটে হত্যা করা হয়েছে। নিহত সীমা আক্তার পাবনার ফরিদপুর থানার বিয়ালবাড়ী গ্রামের জাহিদুল ইসলামের মেয়ে। একইদিন পাবনার সাঁথিয়া উপজেলায় আল আমিন হোসেন (৩৫) নামে এক চরমপন্থী নেতাকে গলাকেটে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। তিনি একই গ্রামের ফজলাল মিয়ার ছেলে এবং চরমপন্থী সংগঠন পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি এমএলের (লাল পতাকা) আঞ্চলিক নেতা ছিলেন। এদিন বিকেলে রাজশাহী শিল্প ও বণিক সমিতির সাবেক প্রশাসক ও জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ জিয়াউল হক টুকু (৫২) নিজ পিস্তলের গুলীতে মারা গেছেন। এর আগে রাজশাহী নগরভবনের সামনে দরিখরবনায় তার নিজ চেম্বারে গুলীবিদ্ধ হন। এছাড়া গত ১৮ এপ্রিল ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলায় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পার্শ্ববর্তী গ্রামের একটি পরিবারের কিলঘুষিতে মো. আনোয়ার হোসেন (৫৫) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। এদিন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় পূর্বশত্রুতার জের ধরে দু’জনকে কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষের লোকজন। তারা হলেন আবুল কাশেম ও মঞ্জুর হোসেন।

তৃতীয় ধাপের নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় ফরিদপুর, গাজীপুর, পাবনা ও মাগুরায় ৪ জন নিহত হয়েছেন। সিলেটের ওসমানীনগরে ধর্ষণে বাধা দেয়ায় পানিতে ফেলে রাইজুল মিয়া (৭) নামে এক শিশুকে হত্যা করা হয়। পঞ্চগড় জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সেরেস্তা থেকে রামেশ্বর সাহা (৫৫) নামে এক দায়রা সহকারীর (সেশন সহকারী) ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। আদালতের নেজারত শাখার (নায়েম নাজিরের চেম্বার) গ্রিলের সঙ্গে রশিতে ঝুলন্ত অবস্থায় তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

গত ২৩ এপ্রিল রাজশাহীর শালবন এলাকায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে গলাকেটে হত্যা করা হয়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। বগুড়ার শেরপুর শহরে শারমিন আক্তার তনি (২৬) নামে এক গৃহবধূর গলাকেটে হত্যা করেছে স্বামী। নিহত শারমিন শেরপুর উপজেলা সদরের ধুনটমোড় এলাকায় শফিকুল ইসলাম তারুর মেয়ে। ঘটনার পর থেকে দুই সন্তান নিয়ে স্বামী পলাতক রয়েছে। এছাড়া বগুড়ার শেরপুরে শারমিন আক্তার তনু নামের এক গৃহবধূকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তনির শ্বশুরের নির্বাচনী ব্যয় মেটানোর টাকা না পেয়ে স্বামী আব্দুল মতিন তাকে নৃশংসহভাবে হত্যা করে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনার পরদিন রাজশাহী নগরীর হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ধর্ষণের পর ওই ছাত্রীকে হত্যা করা হয়।

গত শনিবার ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলায় নির্বাচনী সহিংসতায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর ভাইকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। ওইদিন বিকেলে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় সাধু পরমানন্দ রায়কে (৭৫) কুপিয়ে হত্যা করা হয়। মাগুরার শ্রীপুরে চর জোকা গ্রামে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় বাবলু মিয়া নামে একজন নিহত হয়েছেন। গাজীপুরে হযরত আলী নামে আরও একজন নির্বাচনী সহিংসতায় মারা গেছেন।

গত ২২ এপ্রিল ঝিনাইদহে ভাইয়ের লাঠির আঘাতে ভাই নিহত হয়েছে। এছাড়া যশোর শহরের নিউমার্কেট এলাকায় শামীম হোসেন (২৫) নামের এক তরুণকে পিটিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এদিন কক্সবাজারের টেফনাফ উপজেলায় বাড়িতে ঢুকে গুলী করে মোহাম্মদ হাসেম নামের এক যুবককে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। উপজেলার হামজা পাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ড উপজেলা শহরে তালাকপ্রাপ্ত স্বামী স্ত্রীকে হত্যা করেছে। নিহত ওই নারী হরিণাকু-ুর ফজলুর মেয়ে লিপা খাতুন (২২)। পুলিশ স্বামী ঠান্ডু মণ্ডলকে আটক করেছে। ২৩ এপ্রিল সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সোনারায় ইউনিয়নের বলরাম গ্রামে লাইজু বেগম (২৬) নামে এক গৃহবধূর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

টেকনাফে ইয়াবা ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে প্রতিপক্ষের গুলীতে খুন হয়েছে মো. হাশেম (৩৫) নামে এক যুবক। ২১ এপ্রিল সাটুরিয়ায় এক মামার মারধর থেকে অপর মামাকে রক্ষা করতে এসে খুন হয়েছে অনাথ কিশোর ভাগ্নে সুশান্ত সরকার (১৬)। ২০ এপ্রিল কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী সীমান্তে বিএসএফের নির্যাতনে আব্দুল বারেক নামের এক গরুর রাখাল (ডাঙ্গালু) মারা গেছে। একইদিন রাজধানীতে পৃথক ঘটনায় দুর্বৃত্তদের হাতে দুই যুবক খুন হয়েছেন। নিহতরা হলেন পরিবহন শ্রমিক আনোয়ার হোসেন (৩৫) ও লেগুনা চালক মো. রানার (২০)। রাজধানীর গাবতলী ও খিলগাঁওয়ে এই ঘটনা দুটি ঘটে।

ওইদিন দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে মাইজচর বিলে আলম মিয়া (৪০) নামে এক কৃষক প্রতিপক্ষের বল্লমের আঘাতে খুন হয়েছেন। ১৯ এপ্রিল চাঁদা না পেয়ে রাজধানীর মুগদায় সন্ত্রাসীরা কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের সাবেক উপপরিচালক আব্দুস শুক্কুরকে (৬২) পিটিয়ে হত্যা করে। ১৭ এপ্রিল বারিশালের বাকেরগঞ্জে পরিছন্নকর্মী গৌতম মালিকে (৪৫) গলাকেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। গত ৪ এপ্রিল রাতে পুরান ঢাকায় মসজিদের ভেতরে মাওলানা মো. বিল্লাল হোসেন (৪৯) নামে একজন মুয়াজ্জিনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এর আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সান্ধ্যকালীন কোর্সের ছাত্র, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও গণজাগরণ মঞ্চের সক্রিয় কর্মী নাজিম উদ্দিন সামাদকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। গত ২০শে মার্চ রাত সাড়ে ১০টায় কুমিল্লা সেনানিবাসের অলিপুর কালো ট্যাংকি এলাকা থেকে সোহাগী জাহান তনুর লাশ উদ্ধার করা হয়। তার পিতা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহায়ক। পরিবারের সঙ্গে সেনানিবাসের অলিপুর এলাকায় থাকতেন তনু।

এখন দেশে তেমন কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই। এরপরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটছে। একের পর এক ঘটেই চলছে লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড। কখনো গলাকেটে, কখনো গুলী করে মানুষ খুন করা হচ্ছে। একটির কিনারা না হতেই ঘটছে আরেকটি। একটির তদন্ত শুরু না করতেই আরকেটি ঘটনা। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। চারদিকে কেবল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। সংগ্রাম।

পাঠকের মতামত: